শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন

শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন
অর্জুন তোমার আমার বহুবার জন্ম হয়েছে। সে কথা তোমার মনে নেই, সবই আমার মনে আছে।

Thursday, May 16, 2013

বৌদ্ধধর্মের সহিত হিন্দুধর্মের সম্বন্ধ-- স্বামী বিবেকানন্দ



বৌদ্ধধর্মের সহিত হিন্দুধর্মের সম্বন্ধ

[১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চিকাগোতে সে বিশ্বমেলা হইয়াছিল, ধর্ম-মহাসভা সেই উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত একটি সন্মেলন।২৬শে সেপ্টেম্বর, ষোড়শ দিবসের অধিবেশনে প্রদত্ত বক্তৃতা]

আপনারা সকলেই শুনিয়াছেন যে, আমি বৌদ্ধ নই, তথাপি একভাবে আমি বৌদ্ধ। চীন, জাপান, ও সিংহল সেই মহান্ গুরু বুদ্ধের উপদেশ অনুসরণ করে, কিন্তু ভারত তাঁহাকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া পূজা করে। আপনারা এইমাত্র শুনিলেন যে, আমি বৌদ্ধধর্মের সমালোচনা করিতে উঠিতেছি; কিন্তু আমি চাই তাহা পূর্বোক্ত অর্থেই গ্রহণ করিবেন; যাঁহাকে আমি ঈশ্বরাবতার বলিয়া পূজা করি, তাঁহার বিরুদ্ধে সমালোচনা করা আমার অভিপ্রায়ই নয়। কিন্তু বুদ্ধদেব সম্বন্ধে আমাদের মত এই যে, তাঁহার শিষ্যগণ তাঁহাকে ঠিক ঠিক বুঝিতে পারেন নাই। ইহুদীধর্মের সহিত খ্রীষ্টানধর্মের যে সম্বন্ধ, হিন্দুধর্ম অর্থাৎ বেদবিহিত ধর্মের সহিত বর্তমানকালের বৌদ্ধধর্মের প্রায় সেইরূপ সম্বন্ধ। যীশুখ্রীষ্ট ইহুদী ছিলেন ও শাক্যমুনি হিন্দু ছিলেন। তবে প্রভেদ এইটুকু যে, ইহুদীগণ যীশুকে পরিত্যাগ করিলেন এবং এমন কি ক্রুশে বিদ্ধ করিয়া হত্যা করিলেন, হিন্দুগণ কিন্তু শাক্যমুনিকে ঈশ্বরের উচ্চাসন দিয়া এখনও তাঁহার পূজা করিয়া থাকেন। কিন্তু আধুনিক বৌদ্ধধর্মের সহিত বুদ্ধদেবের প্রকৃত শিক্ষার যে পার্থক্য আমরা-হিন্দুরা দেখাইতে চাই, তাহা প্রধানতঃ এই : শাক্যমুনি নতুন কিছু প্রচার করিতে আসেন নাই। যীশুর মতো তিনিও ‘পূর্ণ করিতে আসিয়াছিলেন, ধ্বংস করিতে আসেন নাই।’ প্রভেদ এইটুকু যে, যীশুর ক্ষেত্রে প্রাচীনগণ অর্থাৎ ইহুদীরাই তাঁহাকে বুঝিতে পারেন নাই, আর বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে তাঁহার শিষ্যগণই তাঁহার শিক্ষার মর্ম বুঝিতে পারেন নাই। ইহুদীরা যেমন (যীশুর মধ্যে) ওল্ড টেস্টামেন্টের পূর্ণ পরিণতি বুঝিতে পারেন নাই, বৌদ্ধগণও তেমনি(বুদ্ধের মধ্যে) হিন্দুধর্মের সত্যগুলির পূর্ণ পরিণতি বুঝিতে পারেন নাই।
আমি পুনর্বার বলিতেছি : শাক্যমুনি পূর্ণ করিতে আসিয়াছিলেন, ধ্বংস করিতে নয়।; তিনিও ছিলেন হিন্দুধর্মের স্বাভাবিক পরিণতি ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত-ন্যায়সম্মত বিকাশ।
হিন্দুধর্ম দুই ভাগে বিভক্ত-কর্মকান্ড ও জ্ঞানকান্ড; সন্ন্যাসীরাই জ্ঞানকান্ডের আলোচনা করিয়া থাকেন; ইহাতে জাতিভেদ নাই। ভারতে উচ্চতম বর্ণের মানুষও সন্ন্যাসী হইতে পারে, নিম্নতম বর্ণের মানুষও সন্ন্যাসী হইতে পারে, তখন উভয় জাতিই সমান। ধর্মে জাতিভেদ নাই; জাতিভেদ কেবল সামাজিক ব্যবস্থা। শাক্যমুনি স্বয়ং সন্ন্যাসী ছিলেন, এবং তাঁহার হৃদয় এত উদার ছিল যে, লুকানো বেদের মধ্য হইতে সত্যকে বাহির করিয়া তিনি সেগুলি সমগ্র পৃথিবীর লোকের মধ্যে ছড়াইয়া দিলেন-ইহাই তাঁহার গৌরব। পৃথিবীতে ধর্মপ্রচারের তিনিই প্রথম প্রবর্তক; শুধু তাই নয়, ধর্মান্তরিত-করণের ভাব তাঁহারই মনে প্রথম উদিত হইয়াছে।
সকলের প্রতি-বিশেষতঃ অজ্ঞান ও দরিদ্রগণের প্রতি অদ্ভুত সহানুভূতিতেই তাঁহার গৌরব প্রতিষ্ঠিত। তাঁহার কয়েকজন শিষ্য ব্রাহ্মণ ছিলেন। যে সময়ে বুদ্ধ শিক্ষা দিতেছিলেন, সে সময়ে সংস্কৃত আর ভারতের কথ্য ভাষা ছিল না। ইহা সেসময়ে পণ্ডিতদের পুস্তকেই দেখা যাইত। বুদ্ধদেবের কোন কোন ব্রাহ্মণ শিষ্য তাঁহার উপদেশগুলি সংস্কৃতে অনুবাদ করিতে চান, তিনি কিন্তু স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন, ‘আমি দরিদ্রের জন্য-জনসাধারণের জন্য আসিয়াছি, আমি জনসাধারণের ভাষাতেই কথা বলিব।’ আজ পর্যন্ত তাঁহার অধিকাংশ উপদেশ সেই সময়কার চলিত ভাষাতেই লিপিবদ্ধ।
দর্শনশাস্ত্র ও তত্ত্ববিদ্যা যত উচ্চ আসনই গ্রহণ করুক, যতদিন জগতে মৃত্যু বলিয়া ব্যাপারটি থাকিবে, যতদিন মানবহৃদয়ে দুর্বলতা বলিয়া কিছু থাকিবে, যতদিন চরম দুর্বলতায় মানুষের মর্মস্থল হইতে রোদনধ্বনি উত্থিত হইবে, ততদিন ঈশ্বরে বিশ্বাসও থাকিবে। দর্শনশাস্ত্রের দিক দিয়া সেই লোকগুরু বুদ্ধের শিষ্যগণ বেদরূপ সনাতন শৈলের অভিমুখে সবেগে পতিত হইলেন কিন্তু তাহাকে চূর্ণ করিতে পারিলেন না। অপর দিকে যে সনাতন ঈশ্বরকে নরনারী সকলে সাদরে ধরিয়া থাকে, তাঁহাকে সমগ্র জাতির নিকট হইতে অপসৃত করিলেন। ইহার ফলে ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হইয়াছিল। বর্তমানকালে বৌদ্ধধর্মের জন্মভূমি ভারতে এমন একজনও নাই, যিনি নিজেকে বৌদ্ধ বলেন। কিন্তু এইসঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্মও কোন কোন বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হইল। সেই সমাজসংস্কারের জন্য আগ্রহ, সকলের প্রতি সেই অপূর্ব সহানুভূতি ও দয়া, সর্বসাধারণের ভিতর বৌদ্ধধর্ম যে ব্যাপক পরিবর্তনের ভাব প্রবাহিত করিয়া দিয়াছিল, তাহা ভারতীয় সমাজকে এতদূর উন্নত ও মহান্ করিয়াছিল যে, তদানীন্তন ভারতবর্ষ সম্বন্ধে লিখিতে গিয়া জনৈক গ্রীক ঐতিহাসিককে বলিতে হইয়াছে : কোন হিন্দু মিথ্যা বলে বা কোন হিন্দুনারী অসতী-এ-কথা শোনা যায় না।
সভামঞ্চে যে-সকল বৌদ্ধ উপবিষ্ট ছিলেন, তাঁহাদের দিকে ফিরিয়া বক্তা বলিতে লাগিলেন : হে বৌদ্ধগণ! বৌদ্ধধর্ম ছাড়া হিন্দুধর্ম বাঁচিতে পারে না; হিন্দুধর্ম ছাড়িয়া বৌদ্ধধর্মও বাঁচিতে পারে না। অতএব উপলব্ধি করুন-আমাদের এই বিযুক্ত বিচ্ছিন্নভাব স্পষ্টই দেখাইয়া দিতেছে যে, ব্রাহ্মণের ধীশক্তি ও দর্শনশাস্ত্রের সাহায্য না লইয়া বৌদ্ধেরা দাঁড়াইতে পারেন না এবং ব্রাহ্মণও বৌদ্ধের হৃদয় না পাইলে দাঁড়াইতে পারে না। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণের এই বিচ্ছেদই ভারতবর্ষের অবনতির কারণ। এইজন্যই আজ ভারতবর্ষ ত্রিশকোটি ভিক্ষুকের বাসভূমি হইয়াছে, এইজন্যই ভারতবাসী সহস্র বৎসর ধরিয়া বিজেতাদের দাসত্ব করিতেছে। অতএব আসুন, আমরা ব্রাহ্মণের অপূর্ব ধীশক্তির সহিত লোকগুরু বুদ্ধের হৃদয়, মহান্ আত্মা এবং অসাধারণ লোক-কল্যাণশক্তি যুক্ত করিয়া দিই।

No comments:

Post a Comment

Labels

বাংলা (171) বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন (22) ethnic-cleansing (17) ভারতীয় মুসলিমদের সন্ত্রাস (17) islamic bangladesh (13) ভারতে হিন্দু নির্যাতন (12) : bangladesh (11) হিন্দু নির্যাতন (11) সংখ্যালঘু নির্যাতন (9) সংখ্যালঘু (7) আরব ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদ (6) minority (5) নোয়াখালী দাঙ্গা (5) হিন্দু (5) hindu (4) minor (4) নরেন্দ্র মোদী (4) বাংলাদেশ (4) বাংলাদেশী মুসলিম সন্ত্রাস (4) ভুলে যাওয়া ইতিহাস (4) love jihad (3) গুজরাট (3) বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন (3) বিজেপি (3) ভারতে অনুপ্রবেশ (3) মুসলিম বর্বরতা (3) হিন্দু নিধন (3) George Harrison (2) Julia Roberts (2) List of converts to Hinduism (2) bangladesh (2) কলকাতা (2) গুজরাট দাঙ্গা (2) বাবরী মসজিদ (2) মন্দির ধ্বংস (2) মুসলিম ছেলেদের ভালবাসার ফাঁদ (2) লাভ জিহাদ (2) শ্ত্রু সম্পত্তি আইন (2) সোমনাথ মন্দির (2) হিন্দু এক হও (2) হিন্দু মন্দির ধ্বংস (2) হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা (2) Bhola Massacre (1) English (1) april fool. মুসলিম মিথ্যাচার (1) converted hindu celebrity (1) converting into hindu (1) dharma (1) facebook (1) gonesh puja (1) gujrat (1) gujrat riot (1) jammu and kashmir (1) om (1) religion (1) roth yatra (1) salman khan (1) shib linga (1) shib lingam (1) swami vivekanada (1) swamiji (1) অউম (1) অক্ষরধাম মন্দিরে জঙ্গি হামলা ২০০২ (1) অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী (1) অর্পিত সম্পত্তি আইন (1) আওরঙ্গজেব (1) আদি শঙ্কর বা শঙ্করাচার্য (1) আর্য আক্রমণ তত্ত্ব (1) আসাম (1) ইতিহাস (1) ইয়াকুব মেমন (1) উত্তরপ্রদেশ (1) এপ্রিল ফুল (1) ওঁ (1) ওঁ কার (1) ওঁম (1) ওম (1) কবি ও সন্ন্যাসী (1) কাদের মোল্লা (1) কারিনা (1) কালীঘাট মন্দির (1) কাশী বিশ্বনাথ মন্দির (1) কৃষ্ণ জন্মস্থান (1) কেন একজন মুসলিম কোন অমুসলিমের বন্ধু হতে পারে না? (1) কেন মুসলিমরা জঙ্গি হচ্ছে (1) কেশব দেও মন্দির (1) খ্রিস্টান সন্ত্রাসবাদ (1) গনেশ পূজা (1) গুজরাটের জঙ্গি হামলা (1) জাতিগত নির্মূলীকরণ (1) জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (1) জেএমবি (1) দেশের শত্রু (1) ধর্ম (1) ধর্মযুদ্ধ (1) নবদুর্গা (1) নববর্ষ (1) নালন্দা (1) নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (1) নোয়াখালি (1) পঞ্চ দেবতার পূজা (1) পহেলা বৈশাখ (1) পহেলা বৈশাখ কি ১৪ এপ্রিল (1) পাকিস্তানী হিন্দু (1) পূজা (1) পূজা ও যজ্ঞ (1) পূজার পদধিত (1) পৌত্তলিকতা (1) ফেসবুক (1) বখতিয়ার খলজি (1) বরিশাল দাঙ্গা (1) বর্ণপ্রথা (1) বর্ণভেদ (1) বলিউড (1) বাঁশখালী (1) বিহার (1) বুদ্ধ কি নতুন ধর্ম প্রচার করেছেন (1) বৈদিক ধরম (1) বৌদ্ধ দর্শন (1) বৌদ্ধ ধর্ম (1) ভারত (1) মথুরা (1) মরিচঝাঁপি (1) মানব ধর্ম (1) মিনি পাকিস্তান (1) মীরাট (1) মুক্তমনা (1) মুক্তিযুদ্ধ (1) মুজাফফরনগর দাঙ্গা (1) মুম্বাই ১৯৯৩ (1) মুলতান সূর্য মন্দির (1) মুলায়ম সিং যাদব (1) মুসলিম তোষণ (1) মুসলিম ধর্ষক (1) মুসলিমদের পুড়ে মারার ভ্রান্ত গল্প (1) মুহাম্মদ বিন কাশিম (1) মূর্তি পুজা (1) যক্ষপ্রশ্ন (1) যাদব দাস (1) রথ যাত্রা (1) রথ যাত্রার ইতিহাস (1) রবি ঠাকুর ও স্বামীজী (1) রবি ঠাকুরের মা (1) রবীন্দ্রনাথ ও স্বামীজী (1) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (1) রিলিজিওন (1) রুমি নাথ (1) শক্তিপীঠ (1) শঙ্করাচার্য (1) শিব লিংগ (1) শিব লিঙ্গ (1) শিব লিঙ্গ নিয়ে অপপ্রচার (1) শ্রীকৃষ্ণ (1) সনাতন ধর্ম (1) সনাতনে আগমন (1) সাইফুরস কোচিং (1) সালমান খান (1) সোমনাথ (1) স্বামী বিবেকানন্দ (1) স্বামীজী (1) হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম (1) হিন্দু জঙ্গি (1) হিন্দু ধর্ম (1) হিন্দু ধর্ম গ্রহন (1) হিন্দু বিরোধী মিডিয়া (1) হিন্দু মন্দির (1) হিন্দু শিক্ষার্থীদের মগজ ধোলাই (1) হিন্দুধর্মে পৌত্তলিকতা (1) হিন্দুরা কি পৌত্তলিক? (1) ১লা বৈশাখ (1) ১৯৭১ (1)

সাম্প্রতিক মন্তব্য

Blogger Tips and TricksLatest Tips And TricksBlogger Tricks

সর্বোচ্চ মন্তব্যকারী